এনবিআর কি? এনবিআর সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন - বিডি ট্যাক্সেশন
পৃথিবীর যেকোনো দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থসংস্থানের একটি বড় অংশের যোগান আসে বার্ষিক রাজস্ব আয় থেকে, বাংলাদেশও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশের রাজস্ব ব্যাবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। সরকারের পক্ষে সকল রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, আর্থিক আইন প্রণয়ণে সরকারের সহায়তা করে থাকে এনবিআর। এই নিবন্ধে আমরা এনবিআর, এর কাজের ধরণ, প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
এনবিআর কি?
এনবিআর (NBR) এর পূর্ণরূপ National Board of Revenue যা বাংলায় ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ নামে পরিচিত। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের যাবতীয় রাজস্ব, কর, শুল্ক ব্যবস্থাপনা এবং সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি, আর্থিক নীতি প্রণয়ণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এনবিআর-এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের বিভিন্ন খাত থেকে কর আদায় করে সেই অর্থ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ব্যয় করার জন্য সংরক্ষণ করে এবং বার্ষিক বাজেটে আভ্যন্তরীণ অর্থসংস্থানের একটি বড় অংশের যোগান দিয়ে থাকে। ফলে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমে অর্থ বরাদ্দ করা সহজ হয়।
এনবিআর কিভাবে কাজ করে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের অধীনে তিনটি বিভাগ রাজস্ব আদায়ের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। নিম্নোক্ত বিভাগগুলোর মাধ্যমে এনবিআর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং আদায়ের কাজগুলো সম্পাদন করে থাকে;
-
আয়কর বিভাগ: আয়কর বিভাগ ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট করদাতাদের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহ করে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আয়ের ভিত্তিতে আয়কর আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত কর হার অনুযায়ী এই কর আদায় করে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর পাশাপাশি আয়কর বিভাগ করদাতাদের কর রিটার্ন দাখিলের প্রক্রিয়াও পরিচালনা করে।
-
মূসক বা ভ্যাট বিভাগ: মূসক বা মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট হল আয়কর আইনের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকার পণ্য ও সেবার উপর আরোপিত পরোক্ষ কর। এনবিআর-এর ভ্যাট বিভাগ সারা দেশের আর্থিক বিনিময়যোগ্য পণ্য ও সেবার জন্য নির্ধারিত ভ্যাট আদায় করে থাকে যার মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আয় করে থাকে। বর্তমানে প্রচলিত আধুনিক ভ্যাট ব্যবস্থা এনবিআরকে আরও কার্যকরভাবে কর সংগ্রহ করতে সাহায্য করেছে।
-
শুল্ক বিভাগ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য আমদানি বা রপ্তানির ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ী এবং সংস্থাগুলোর জন্য নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদান করা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে সকল প্রকার শুল্ক আদায়ের দায়িত্ব পালন করে থাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর।
উপরোক্ত বিভাগসমূহ ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে ই-ফাইলিং, ই-পেমেন্ট, ই-রিটার্ন ও ই-টিনসহ বিভিন্ন অনলাইন সেবা প্রদান করে থাকে। এই সেবাগুলোর মাধ্যমে করদাতারা ঘরে বসেই অনলাইনে তাদের কর সংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারেন। এর মাধ্যমে এনবিআরের কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ ও সহজ হয়েছে, যা করদাতাদের জন্য সময় সাশ্রয়ী এবং সুবিধাজনক।
এনবিআর প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি সুশৃঙ্খল এবং কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এনবিআর প্রতিষ্ঠার আগে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী শাসনামলে যে কর কাঠামো বিদ্যমান ছিল, তা স্বাধীন বাংলাদেশের চাহিদা পূরণ করতে পারছিল না। ফলে স্বাধীনতার পর সরকার দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আধুনিক ও কার্যকর কর কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে, যার মূল ভিত্তি এনবিআর।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনবিআর তার কর সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন পরিবর্তন এবং আধুনিকায়ন এনেছে। ১৯৮৬ সালে ভ্যাট প্রবর্তনের মাধ্যমে এনবিআর তার কর কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে। এছাড়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এনবিআর বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করেছে, যার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর ফাঁকি রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এনবিআরের ভূমিকা
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার পেছনে এনবিআরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এনবিআর থেকে আদায়কৃত কর দেশের অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য অর্থায়নে ব্যবহৃত হয়।
-
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: এনবিআর দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করা হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
-
উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ: এনবিআর থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে সরাসরি ব্যয় করা হয়। রাস্তা, সেতু, হাসপাতাল, স্কুল, এবং অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন এনবিআরের আদায়কৃত কর থেকে সংগৃহীত অর্থের মাধ্যমে সম্ভব হয়।
-
কর সচেতনতা বৃদ্ধি: এনবিআর নিয়মিত কর সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম পরিচালনা করে। করদাতাদের উৎসাহিত করতে এবং করদানে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে এনবিআর বিভিন্ন প্রচারণা চালায়, যার ফলে দেশের করদাতার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। কর সচেতনতা বৃদ্ধি কর ফাঁকির প্রবণতা কমাতে সহায়তা করে এবং দেশের রাজস্ব আয় বাড়ায়।
-
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা: এনবিআর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক ও কর নীতি পরিচালনা করে, যার মাধ্যমে দেশের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকে এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ পায়।
উপসংহার
এনবিআর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের কর ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব আদায়, এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে এনবিআর দেশের সার্বিক অগ্রগতিতে সহায়তা করে। এনবিআরের সঠিক কার্যক্রম এবং করদাতাদের সহযোগিতা দেশের অর্থনীতিকে আরও মজবুত করে তোলে। তাই এনবিআর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং করদানের প্রতি সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। করদাতাদের সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ কর আদায় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ আরও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।
Comments (0)